এই অধ্যায়ের পাঠ শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব-
প্রিয় শিক্ষার্থী, আজকে আমরা একটি খেলা খেলব। খেলাটির নাম হলো গুপ্তধন অনুসন্ধান।
তোমার বিদ্যালয়েই শিক্ষক ১০টি গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন। চলো একক/দলীয়ভাবে গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করি।
গুপ্তধন অনুসন্ধান খেলার অভিজ্ঞতাটি নিচে লিখে ফেলি।
অভিজ্ঞতা
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
তোমরা যে গুপ্তধন পেয়েছ, সেগুলো হলো পারমী। জীবনের পূর্ণতা লাভের জন্য এই দশটি পারমী খুব প্রয়োজন।
আমরা সকলেই সুন্দর ও সফল জীবন চাই। যে জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বেদনা ও আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। আনন্দময় হবে প্রতিটি ক্ষণ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হবে অকৃত্রিম অন্তরঙ্গ ও প্রীতিপূর্ণ। এ রকম পরিপূর্ণ জীবনই সফল ও সার্থক জীবন। মানুষের সফলতার প্রকাশ হয় তার কর্মে। এর মাধ্যমে মানুষের যশ, খ্যাতি ও গৌরবও বিকাশ লাভ করে। এরকম জীবন সকলেরই প্রত্যাশিত। কিন্তু অনায়াসে এ রকম জীবন অর্জন সম্ভব নয়। এ জীবন গঠনের জন্য যেমন পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি লক্ষ্য অর্জনে হতে হয় অধ্যবসায়ী ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বৌদ্ধ দর্শনমতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য অত্যন্ত কঠিন কঠোর নীতি পালন করতে হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে এরকম লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়াকে বলে পারমী। পারমী বহু জন্মের সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
পারমী শব্দের সরল অর্থ হলো পূর্ণতা। আর পূর্ণতা মানে সকল প্রকার তৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে বিশুদ্ধ জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছা। ক্লেশমুক্ত জীবনের সাফল্যে বিভূষিত হওয়া। মহৎ গুণ ও উৎকর্ষের পরম শীর্ষস্থান লাভ করা। এ ছাড়া পাড়ে যাওয়া অর্থেও পারমী বলা হয়। পাড় মানে নদীর পাড় বা তীর। এই জগৎ সংসার দুঃখ ও যন্ত্রণার সাগর। আমরা সকলেই নানাবিধ যন্ত্রণা নিয়ে এই সাগরেই ভাসছি। এখানে সাগর হলো একটি রূপক শব্দ। জীবনের অন্তহীন সমস্যার প্রতিশব্দ এটি। এই দুঃখময় সংসার সাগর থেকে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করে নিজের জীবনকে সৎ কর্ম ও সাধনায় পূর্ণতা দিতে পারলেই প্রকৃত মুক্তি সম্ভব হয়। এই দুঃখ মুক্তির পথ অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টসাধ্য। তা সত্ত্বেও অনেক মুনি-ঋষি এই পথ অনুশীলন করেন এবং অনেকে পূর্ণতাও লাভ করেন। এই পারমী পরিক্রমায় পূর্ণতা অর্জনকারী ব্যক্তিই হন বিশুদ্ধ ব্যক্তিত্ব।
বৌদ্ধ দর্শনে পারমী একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। পারমী সাধারণত ভবিষ্যৎ জীবনে বুদ্ধত্ব অর্জনের মহৎ অভিপ্রায়ে অনুশীলন করা হয়। এটি যিনি পালনে ব্রতী হন, তাঁকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। এ পারমী একটি অনুশীলনীয় তত্ত্ব; জন্ম-জন্মান্তরে পণবদ্ধ হয়ে সম্পাদনীয় একটি প্রক্রিয়া। এ তত্ত্বের গুরুত্ব অনুধাবন হয় জীবন চর্যার মাধ্যমে। সে নিরিখে পারমী প্রক্রিয়াকে একটি উন্নত নৈতিক জীবন প্রক্রিয়াও বলা যায়। চিত্ত ও কায় সংযোগে ব্রত বা প্রত্যয়ের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। তাই পারমী হলো একধরনের ব্রত বা পণবদ্ধ কর্মানুশীলনী অভিযাত্রা।
বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন বিধিমতে পারমী দশটি। অনুশীলন কার্যক্রমে এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক রয়েছে। একটি অনুসরণে কোনো কারণে ব্যত্যয় হলে অন্যটি পালনেও এই দুর্বলতার প্রভাব পড়ে। এটি হাতের মুষ্টিবদ্ধতার মতো। একটি আঙুল বাদ দিলে যেমন মুষ্টি শক্ত হয় না, ঠিক তেমনি দশ পারমীর কোনো একটি অনুসরণে ব্যর্থ হলে অন্যটি পালন করার দৃঢ়তা হ্রাস পায়। এই পারমীগুলো সাধনাকারীর লক্ষ্য অর্জনের মার্গকে শানিত করে। অনুক্রমিক ধারায় এ পারমীগুলো পালন করতে হয়। অতীতের সকল বুদ্ধ বোধিসত্ত্বকালীন এই পারমীর অধিষ্ঠানব্রত পূর্ণ করেছিলেন। শুধু সম্যক সম্বুদ্ধ নয়, তাঁদের অনুগামী শ্রাবকবুদ্ধ ও প্রত্যেক বুদ্ধও এ পারমী ব্রত পূর্ণতার সাধনা সম্পাদন করেছিলেন।
নিচে দশ পারমীর নাম উল্লেখ করা হলো-
১. দান পারমী
২. শীল পারমী
৩. নৈষ্ক্রম্য পারমী
৪. প্রজ্ঞা পারমী
৫. বীর্য পারমী
৬. ক্ষান্তি পারমী
৭. সত্য পারমী
৮. অধিষ্ঠান পারমী
৯. মৈত্রী পারমী
১০. উপেক্ষা পারমী
তোমরা ইতিমধ্যে জেনেছ, পারমী হলো নিজেকে বিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। এই বিশুদ্ধিতা হলো আচরণ ও মনোজগতের। মানুষের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে তার চিন্তা-ভাবনার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃত অর্থে মানুষ যা ভাবে বা চিন্তা করে, সেটিই তার আচরণে প্রকাশ পায়। তাই একজন বিশুদ্ধ মানুষ বলতে তাঁকেই বোঝায়, যিনি ব্যবহারে, কথায় ও চিন্তায় বিশুদ্ধ। এই বিষয়গুলো মানুষকে অর্জন করতে হয়। এর জন্য শ্রম, সাধনা প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, দায়বদ্ধ হয়েই এটি অনুশীলন করতে হয়। পারমী তেমনি একটি নিত্য পালনীয় ও অনুসরণীয় বিষয়। অনুশীলনীয় পারমীর মূল ধাপ দশটি। প্রতিটি পারমী অনুশীলিত হয় তিন পর্যায়ে; অনুক্রমিকভাবে। যেমন: পারমী, উপ-পারমী ও পরমার্থ পারমী। সে হিসাবে দশ পারমী অনুশীলনের ক্ষেত্রে ত্রিশ পর্যায় বা ধাপে পরিণত হয়।
এখানে প্রতিটি পারমী অনুশীলনের প্রাথমিক পর্যায়। উপ-পারমী হলো মধ্যম ও পরমার্থ পারমী হলো চূড়ান্ত পর্যায়। এগুলো ধারাবাহিকভাবে অনুসরণের উর্ধ্ব দিকে যাত্রা। পারমী অনুশীলনে প্রতিশ্রুতিবন্ধ বা পণবদ্ধ হলেই ক্রমে ধাপ অতিক্রম সম্ভব হয়।
দশ পারমীর মধ্যে প্রতিটির স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় আছে। আচরণের দিক থেকে একটি পারমী অন্যটির সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও লক্ষ্য ও মূল্যবোধ ভিন্ন। একেকটির পৃথক পৃথক আবেদন রয়েছে। অনুসরণের ক্ষেত্রে সেই বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত থাকতে হয়। তাই প্রতিটি পারমীর পরিচয় জানা আবশ্যক। নিচে দশ পারমীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
দশ পারমীর প্রথমটি হলো দান পারমী। দানে চিত্ত জাগ্রত হলে প্রসন্নভাবের সৃষ্টি হয়, সেই প্রসন্ন চিত্তে জাগে শীল, সমাধি, শ্রদ্ধা, মৈত্রী, করুণা ইত্যাদি সদ্ চৈতন্য জাগে। যার মাধ্যমে অন্যান্য পারমী পালনে চিত্ত প্রসারিত হয়। স্বাভাবিকভাবে দান কর্ম অনুশীলন সহজ। এই কার্যক্রম সব সময় চর্চা করা যায়।
সাধারণত বাহ্যিক বস্তু দানকে দান উপ-পারমী বলা হয়। বাহ্যিক বস্তু বলতে বোঝায় নিজের অধীনস্থ সম্পত্তি। অর্থাৎ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দানই হলো দান পারমী। নিজের শরীরের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ ও রক্তদানকে বলা হয় দান উপ-পারমী। প্রয়োজনে জীবন দান করাকে পরমার্থ পারমী বলা হয়।
আচরণে, কথায় ও চিন্তায় সংযমশীলতার অনুসরণই শীল। শীল হলো মানুষের সকল গুণ সম্ভারের উৎস। সচ্চরিত্র, সদাচার, গুণাচার ও সংযমশীলতার অনুশীলনই শীল। নৈতিক আদর্শে সুদৃঢ় থাকাই হলো শীলের লক্ষণ। আচরণের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকার শীল আছে। সেগুলোর বিভিন্ন নামও রয়েছে। এর মধ্যে চারিত্রশীল ও বারিত্রশীল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিজে অনুপ্রাণিত হয়ে পালন করা নিয়ম-নীতিই হলো চারিত্রশীল। আর বিধিবদ্ধ শিক্ষাপদ বা নীতি অনুশীলন হলো বারিত্র শীল। দান পারমীর মতো শীল পারমীর তিনটি পর্যায়ে রয়েছে যেমন: প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দৈনন্দিন জীবনে শীল পালন হলো শীল পারমী। জীবনে কোনো কিছুর বিনিময়ে শীল বিচ্যুত না হওয়ার সংকল্পবদ্ধ থাকাই হলো শীল উপ পারমী। এছাড়া শীল পালনের প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়াকে বলে পরমার্থ পারমী। প্রত্যেক পারমীই এরকম ত্রিমাত্রিক পর্যায়ে অনুশীলিত হয়।
নৈষ্ক্রম্য শব্দের উদ্ভব নিষ্ক্রমণ থেকে। যার অর্থ ত্যাগ, বন্ধন ত্যাগ, বিদায় ইত্যাদি। জগতের সমস্ত ভোগ-বিলাস ও অহংকার-অহমিকা থেকে বিদায়। নৈষ্ক্রম্য জীবনাচারের আদর্শ হলো কল্যাণমুখী মানসিকতায় নিজেকে গড়ে তোলা। সকল প্রকার অন্যায় ও দুরাচার থেকে বিরত থাকা। লোভ, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে থাকা। নৈষ্ক্রম্য সাধনার চূড়ান্ত অবস্থান ব্রহ্মচর্য। প্রাথমিকভাবে ভদ্রতা, নম্রতা, সততা ও সংযম রক্ষার প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে এই সাধনার সূচনা করতে হয়।
প্রজ্ঞা মানে জ্ঞান; সম্যক জ্ঞান। অর্থাৎ, জ্ঞান সম্প্রযুক্ত চিত্তকে বলে প্রজ্ঞা। সুতরাং কোনো বিষয়কে প্রকৃষ্টরূপে জানার জন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে যে জ্ঞান সাধনা করা হয়, তাকেই প্রজ্ঞা পারমী বলে। এটি দশ পারমীর চতুর্থ পর্যায়। প্রজ্ঞা পারমীর চর্চায় মানুষের সম্যক জ্ঞান লাভের ধারা শানিত হয়। অন্য সকল পারমীর অনুশীলনেও প্রজ্ঞা পারমীর প্রভাব রয়েছে। এখানে সম্যক জ্ঞান বলতে মূলত নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে সঠিক বিবেচনাকে বোঝায়; যা মানুষের চিন্তা ও পরিকল্পনায় সর্বতোভাবে সক্রিয় থাকে।
বলাবাহুল্য, মানুষের ধর্মীয় জীবন ও পারিবারিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রজ্ঞা সাধনার গুরুত্ব রযেছে। আধ্যাত্মিক উৎকৃষ্টতা অর্জনে যেমন প্রজ্ঞার প্রয়োজন, তেমনি গৃহী জীবনে যশ ও খ্যাতি লাভের জন্যও প্রজ্ঞাসাধনার প্রয়োজন অপরিসীম। প্রজ্ঞাসাধনা ছাড়া মহৎ কাজ করা সম্ভব নয়। তাই বলা হয়, প্রজ্ঞাশক্তি যত প্রবল হবে, তত বেশি শুদ্ধ চেতনার বিকাশ হবে। অর্থাৎ সর্বকল্যাণ ও মঙ্গলকর্মের উৎসে প্রজ্ঞার প্রাধান্য রয়েছে। এছাড়া এটিও সত্য যে, প্রজ্ঞায় পূর্ণতা না এলে সাধনায়ও পূর্ণতা আসে না। এই প্রজ্ঞা পারমীর তিনটি রূপ হলো চিন্তাময়-প্রজ্ঞা, শ্রুতময়-প্রজ্ঞা ও ভাবনাময়-প্রজ্ঞা।
বীর্য শব্দের অর্থ হলো বীরত্ব, কর্মোদ্দীপনা ও কর্মচাঞ্চল্য। যথাসময়ে যথোপযুক্ত কাজের উদ্যোগ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হওয়াকে বলে বীর্য পারমী। এটি দশ পারমীর পঞ্চম স্তর। বীর্য পারমী অনুশীলনের জন্য মনে বিশুদ্ধ কর্ম ও সর্বজনীন হিতকর্ম করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, উৎসাহ ও মহৎ প্রচেষ্টা থাকতে হয়; যা সাধক অটল দৃঢ়চিত্তে অনুসরণ করেন। যাঁর এরকম চিত্ত জাগ্রত হয়, তাঁর দুঃখ মুক্তির পথও সুগম হয়। সাধনা যাঁর দুর্বল, তিনি কখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না। যাঁর সাধনা মধ্যম স্তরের, তিনি যেকোনো কাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেন না। কিন্তু যাঁর সাধনা উত্তম ও সুদৃঢ়, তিনি স্বাভাবিক গতিতেই লক্ষ্যে পৌঁছে যান। সাধনায় দৃঢ় ও কঠিন হলে প্রপঞ্চ ও মরীচিকা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এছাড়া বীর্য পারমীর সাধক একটি উন্নত চরিত্র ও আদর্শিক জীবনলাভে সমর্থ হয়। প্রত্যেক বুদ্ধ ও শ্রাবক বুদ্ধগণও এই বীর্য পারমীর পরিপূর্ণতার গুণে মহিমান্বিত হয়েছেন।
ক্ষান্তি মানে ক্ষমা। ক্ষান্তি পারমীর চর্চা হলো সহনশীলতার সাধনা করা। সহ্য, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অনুশীলনের মাধ্যমে এই সাধনা করতে হয়। পৃথিবী যেমন তার ওপর শুচি-অশুচি নানাবিধ বস্তু নিক্ষেপিত হলেও নীরবে সহ্য করে, নিক্ষেপকারীর প্রতি দয়া বা ক্রোধ কোনো কিছুই প্রদর্শন করে না, তেমনি সকল মান-অপমান সহ্য করাই ক্ষান্তি পারমী।
সত্য বলা ও সততা অনুসরণে সংকল্পবদ্ধ হওয়াই সত্য পারমী। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে সদাচার নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা এবং সকল কাজে সত্যব্রত সাধনই হলো সত্য পারমী। কোনো অবস্থাতেই সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। সত্য পারমীতে কথা ও কাজের একাত্মতা থাকবে, কোনো দ্বৈতচিত্ত ভাবের প্রকাশ হবে না। এই সত্য সাধনার মূল্যায়ন নিজেকেই করতে হয়। সত্যের কোনো বিকল্প নেই। সত্যের পরিপন্থী কোনো বিষয়ের সঙ্গে কোনো আপস নেই। প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া যাবে; কিন্তু সত্যের অপলাপ কখনো হবে না- সত্য অনুসরণে এই ব্রতই সত্য পারমী।
এটি দশ পারমীর অষ্টম ধাপ। সংকল্প ও প্রতিশ্রুতি পালনে অটল থাকার কঠিন সিদ্ধান্ত অনুসরণকেই অধিষ্ঠান পারমী বলে। চিত্তের এই একাগ্রতা ও অবিচল দৃষ্টিভঙ্গিই অধিষ্ঠান পারমীর প্রাণ। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অধিষ্ঠান ব্রতের প্রয়োজন রয়েছে। স্বর্ণকে যেমন আগুনে পুড়িয়ে এর মলিনতা দূর করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়, তেমনি অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য আরাম-আয়াস ত্যাগ করে অধিষ্ঠানকে প্রবলতর করতে হয়। লক্ষ্য অর্জনে সদিচ্ছার সৃষ্টি করতে হয়। এই সদিচ্ছা হবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কর্ম সম্পাদনে জীবনপণ সদিচ্ছা। চঞ্চল চিত্তকে সাম্য দানের সদিচ্ছা। মানুষের সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় জীবনের সার্থকতা লাভের জন্য সর্বক্ষেত্রে চিত্তচাঞ্চল্য পরিহার করা আবশ্যক। অস্থির চিত্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সেজন্য বলা হয়, মানবজীবনের সার্বিক কল্যাণের প্রধান অবলম্বন হলো অধিষ্ঠান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অধিষ্ঠান ব্রত আবশ্যক। কারণ, সংকল্পবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হলে জীবনে সাফল্য আসবেই। তাই বলা হয়ে থাকে- অধিষ্ঠান মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের অন্যতম শক্তি।
নিজের মনে সর্বদা মৈত্রীভাব জাগ্রত রাখার সংকল্পবন্ধ হওয়াই মৈত্রী পারমীর সাধনা। এই সাধনা আচরণে, চিন্তায় ও কথায় সর্বক্ষেত্রে অনুশীলন করতে হয়। সর্ব জীবের শুভকামনা ও সর্বসত্তার মঙ্গল চেতনাই মৈত্রী। মৈত্রী সাধনা অন্তরের হিংসা বিনাশ করে এবং নিঃস্বার্থ পরোপকারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সকল জীবের সঙ্গে একাত্মতা পোষণই মৈত্রীর স্বভাব। জল যেমন সৎ-অসৎ, হীন-উত্তম সকলকেই ধৌত করে, শীতল করে; তেমনি শত্রু-মিত্র সকলের প্রতি সমান প্রীতিভাব পোষণ করে মৈত্রী সাধনায় পূর্ণতালাভ করতে হয়।
সর্ববিধ বিষয়ে ও সকলের প্রতি মনের সমতাভাব বজায় রাখার দৃঢ় অনুশীলনই উপেক্ষা পারমী। এটি একপ্রকার লোভ-হিংসা বর্জিত মনোচেতনা। এই সাধনায় চিত্ত অনুরাগ-বিরাগশূন্য মধ্যম অবস্থাধীন হয়। এটি দশ পারমীর সর্বশেষ পারমী।
উপেক্ষার অনুশীলনে চিত্তে যে সাম্যভাব সৃষ্টি হয়, তাতে আত্ম-পর ভেদ মন থেকে ঘুচে যায়। সাধকের সর্বজনীন উদার মনোবৃত্তি জাগ্রত হয়। উপেক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় জ্ঞান দ্বারা। তবে নিজের দায়িত্ব অবহেলা করে উপেক্ষার অনুসরণ গ্রহণযোগ্য হয় না। অর্থাৎ উপেক্ষার মাধ্যমে সকলের জন্য যেমন সেবা, মৈত্রী ও বন্ধুত্বভাব থাকবে, তেমনি সততা ও দায়িত্বের সঙ্গে নিজের কর্তব্য কর্মও পালন করতে হবে। উপেক্ষা অনুসরণকারী কারো প্রশংসায় উৎসাহিতও হয় না; আবার কারো বিরুদ্ধাচরণে কুপিতও হয় না। তাঁর চিত্ত থাকে সর্বদা সমভাবাপন্ন; মধ্যম স্বভাবের। যেমন নিজের প্রিয়জনকে দেখে উল্লসিতও নয়, আবার অপ্রিয়কে দেখে বিষাদময়ও নয়। চিত্তের এই স্থিত ভাব এক দিনে আসে না। এটি ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়। এই চর্চা নিজের জন্য যেমন অত্যন্ত ফলপ্রসূ, তেমনি অন্যের জন্যও এটি পরম কল্যাণকর।
ধর্মীয় বই, ইন্টারনেট বা অন্যন্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দলীয়ভাবে পারমী বিষয়ে তথ্যফুল তৈরি করি।
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
পারমীর অনুশীলন অত্যন্ত কঠিন। এ প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ কঠোর ধারায় প্রবহমান থাকে। জন্ম-জন্মান্তরের অখন্ডিত ও অবিচ্ছিন্ন স্রোতধারায় চলে এর সাধন প্রক্রিয়া। যাকে দুঃখমুক্তির অভিযানও বলা যায়। এই ব্রতাচার বা পণবদ্ধতা এমন সুকঠিন যে, পারমী পালনকারীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে; কিন্তু কোনো কারণেই আদর্শচ্যুতি ঘটে না। এমনই অনির্বচনীয় আদর্শের অধিকারী হয় পারমী আচার পালনের অভিলাষী ব্যক্তি। তিনি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সুকঠিন দৃঢ়তা অবলম্বন করেন। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পালন করেন তাঁর আরাধ্য কর্ম। জীবন রক্ষার চেয়ে ব্রত রক্ষা করা বা অভীষ্ট অর্জনই পারমী চর্চাকারীর কাছে বড়। এ রকম চিত্তানুভূতি সাধনচিত্ত ছাড়া সাধারণের বোধগম্য নয়।
পারমী অনুশীলনকারীর কঠিন দৃঢ়তার জন্য প্রস্তুতিও প্রয়োজন। বৌদ্ধ দর্শনমতে বহু জন্মের সুকৃতির ফল না থাকলে এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় না। জন্ম-জন্মান্তরের মন ও শরীরের সমন্বিত সাধনার ফলেই মানুষের জীবনে এই প্রস্তুতির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। অত্যন্ত কঠিন-কঠোর এই পথ চলার প্রকৃতি। এটি হলো মুক্তি অন্বেষীর মার্গ বা পথ। এই মুক্তি লাভের পথ সুদীর্ঘ। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণায় পূর্ণ এ পথ। তাই এই সীমাহীন এবং অজ্ঞাত ও অচিন্তিত কষ্টের ভার গ্রহণ করে মুক্তিমার্গ পাড়ি দেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস সত্যিই বিরল। এর জন্য পূর্ব জন্মসমূহের অপরিসীম কুশল কর্ম ও কর্মফলের প্রভাব রয়েছে। এই কুশল কর্মের ক্রমোন্নতি বা উৎকর্ষের ফলে কুশল চর্চাকারীর অন্তরে যখন প্রজ্ঞার উদ্ভব ঘটে, তখন ধারাবাহিক কর্মোন্নতির প্রয়াস ঘটে। এই ধারাবাহিক কর্মোন্নতির প্রয়াসই হলো পারমী; আর যে সত্তার অন্তরে এই পারমী পূরণের বা পালনের অদম্য ইচ্ছার সৃষ্টি হয়, তাঁকে বলা হয় 'বোধিসত্ত্ব'।
জাতক সাহিত্যে বোধিসত্ত্বের পারমী সাধনার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত রয়েছে। পারমী অনুশীলনের প্রকৃতি জ্ঞাতার্থে একটি জাতক কাহিনি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এখানে 'মহাকপি' জাতকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ জাতকের কাহিনিটি অনুধাবন করলে দশ পারমীর প্রকৃতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে দশ পারমীর পূর্ণ উপস্থিতি ও এগুলোর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
বোধিসত্ত্ব পারমী চর্চার কালে বিভিন্ন প্রাণিকুলে জন্ম নিয়েছিলেন। সে সময় প্রাচীন ভারতের কাসী গ্রামে তিনি একবার বানর প্রজাতিতে জন্মগ্রহণ করেন। সেই গ্রামের অদূরেই ছিল এক বন। বানররূপী বোধিসত্ত্ব সেই বনেই বাস করতেন। কাসী গ্রাম থেকে বনে যাতায়াতের সুব্যবস্থা ছিল। সে গ্রামের এক কৃষক একদিন তার কয়েকটি গরুকে জমিতে ছেড়ে দিয়ে নিজে চাষের কাজ করছিলেন। গরুগুলোও ঘাস খাওয়ার জন্য বিস্তীর্ণ জমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজ শেষে যখন বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় হলো, তখন কৃষক তার একটি গরু খুঁজে পেলেন না। ভীষণ চিন্তিত হলেন তিনি। গরুর সন্ধানে তিনি এদিক-সেদিক ছুটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে কৃষক গ্রাম সংলগ্ন হিমালয়ের নিকটবর্তী গভীর বনে নিজের অজ্ঞাতেই ঢুকে পড়লেন। এ সময় মনের ভুলে কৃষক পথও হারিয়ে ফেললেন। দিক ভুলে যাওয়ায় বনে ঘুরতে ঘুরতে কৃষকের সপ্তাহকাল কেটে গেল। অনাহারে ও মানসিক চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন কৃষক। একদিন বনে ঘুরতে ঘুরতে কৃষক একটি ফলবৃক্ষ দেখে তাতে উঠে ফল খেতে লাগলেন। হঠাৎ পা পিছলে তিনি গাছ থেকে পড়ে যান। পড়লেন মাটিতে নয়, গভীর এক অন্ধকূপসদৃশ গহবরে, যা গাছের পাশেই ছিল। জীবনের মায়া ত্যাগ করে উপায়হীনভাবে সেই গহ্বরে কৃষক দশ দিন পার করলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ প্রায় অচেতন হয়ে এলো। এমন সময়ে বোধিসত্ত্ব ঐ গাছের ফল খেতে গিয়ে তিনি গর্তে পতিত কৃষককে দেখতে পেলেন। একজন মানুষের দুরবস্থা বানররূপী বোধিসত্ত্বের মনে অসীম দয়ার উদ্রেক হলো।
বানর মৃত্যুপথযাত্রী সেই কৃষককে বাঁচাতে উদ্যত হলো। বানর এ কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগে নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন হলো। এরপর বানর তার ইচ্ছার বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করল। নিচে বানরের ইচ্ছা বাস্তবায়নের কার্যক্রগুলো অনুক্রমিকভাবে উল্লেখ করা হলো। এতে দশ পারমীর বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখা যায়। যেমন:
১. একজন মানুষকে অসহায় অবস্থায় দেখে বানরের চিত্ত কৃষকের কল্যাণে অনুপ্রাণিত হলো। প্রেম ও করুণায় পূর্ণ হলো তার হৃদয়। মনে হলো, যেন তার নিজের সন্তান কূপে পড়ে আছে। বানরের এ রকম অনুভূতি জাগল।
২. তখন বানর নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সেই কৃষককে উদ্ধার করার সংকল্পবদ্ধ হলো।
৩. এরপর কৃষককে উদ্ধারের জন্য বানর নানা উপায়ে চিন্তা করতে লাগল। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর বানর এই সিদ্ধান্তে এলো যে, কৃষককে পিঠে নিয়ে কূপ থেকে এক লাফে উপরে উঠে আসতে পারলেই তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
৪. তবে এতে বিপদের আশঙ্ক্ষাও কম নয়। কূপ থেকে লাফ দিয়ে যদি প্রয়োজন অনুসারে উপরে উঠতে ব্যর্থ হয়, এতে এই দুর্বলকায় কৃষকের মৃত্যু অবধারিত। তাই এ অভিযানের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বানর কৃষকের ওজনের আনুমানিক পরিমাপের এক খন্ড পাথর তার নিজের পিঠে বেঁধে কয়েকবার গর্ত থেকে লাফ দিয়ে ওঠার পরীক্ষা সেরে নিল। এভাবে পরীক্ষামূলক প্রস্তুতিতে বানরের সামর্থ্য প্রমাণিত হওয়ার পর বানর নিজের পিঠে কৃষককে বেঁধে কূপ প্রান্তে লাফ দিয়ে উঠে এলো। বানরের এ অভিযান সার্থক হলো। কৃষক নির্ঘাত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেল।
৫. বানর জানত যে, কৃষককে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টায় তার নিজেরও মৃত্যু ঘটতে পারে, এতে বানর পিছপা হয়নি। অন্যের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েই বানর এ অভিযান পরিচালনা করেছিল।
৬. কৃষককে নিয়ে বানর কূপ থেকে ওঠার পর ভীষণ পরিশ্রান্ত হলো। কৃষকও ছিল প্রায় অচেতন। এ সময় অচেতন কৃষকের কোলে মাথা রেখে বানর একটু বিশ্রাম নিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কৃষকের সম্বিৎ ফিরে এলো। বানরকে কাছে পেয়ে তার অন্তরে লোভ ও মোহচৈতন্য জাগ্রত হলো। তখন তার চিত্তে অকৃতজ্ঞতাবোধ তীব্র হলো। বিশ্রামে ঘুমন্ত বানরটিকে হত্যা করে মাংস নিয়ে ঘরে যাবার বাসনা হলো কৃষকের। সেরকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক খণ্ড পাথর নিয়ে পরিশ্রান্ত অচেতন বানরের মাথায় আঘাত হানল কৃষক। এতে বানরের মৃত্যু ঘটল না বটে, কিন্তু মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বানর দ্রুত একটি গাছে উঠে পড়ল। বানর অত্যন্ত মনোকষ্ট পেল। কিন্তু কৃষকের প্রতি তার কোনো প্রকার প্রতিহিংসা বা ক্রোধ জন্ম নিল না।
৭. কারণ, কৃষককে বাঁচানোর জন্য সে নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এমনকি বানর তার কায়বাক্যে ও কর্মে কৃষককের প্রতি কোনো প্রকার শত্রুতা বা অসন্তুষ্টি দেখাল না।
৮. কৃষক যে বানরের জীবননাশের চেষ্টা করেছিল, তা বানর সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলল, এবং কৃষকের প্রতি আগের মতো মানসিক সমতা অব্যাহত রাখল।
১. একজন মানুষকে অসহায় অবস্থায় দেখে বানরের চিত্ত কৃষকের কল্যাণে অনুপ্রাণিত হলো। প্রেম ও করুণায় পূর্ণ হলো তার হৃদয়। মনে হলো, যেন তার নিজের সন্তান কূপে পড়ে আছে। বানরের এ রকম অনুভূতি জাগল।
২. তখন বানর নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সেই কৃষককে উদ্ধার করার সংকল্পবদ্ধ হলো।
৩. এরপর কৃষককে উদ্ধারের জন্য বানর নানা উপায়ে চিন্তা করতে লাগল। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর বানর এই সিদ্ধান্তে এলো যে, কৃষককে পিঠে নিয়ে কূপ থেকে এক লাফে উপরে উঠে আসতে পারলেই তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
৪. তবে এতে বিপদের আশঙ্ক্ষাও কম নয়। কূপ থেকে লাফ দিয়ে যদি প্রয়োজন অনুসারে উপরে উঠতে ব্যর্থ হয়, এতে এই দুর্বলকায় কৃষকের মৃত্যু অবধারিত। তাই এ অভিযানের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বানর কৃষকের ওজনের আনুমানিক পরিমাপের এক খন্ড পাথর তার নিজের পিঠে বেঁধে কয়েকবার গর্ত থেকে লাফ দিয়ে ওঠার পরীক্ষা সেরে নিল। এভাবে পরীক্ষামূলক প্রস্তুতিতে বানরের সামর্থ্য প্রমাণিত হওয়ার পর বানর নিজের পিঠে কৃষককে বেঁধে কূপ প্রান্তে লাফ দিয়ে উঠে এলো। বানরের এ অভিযান সার্থক হলো। কৃষক নির্ঘাত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেল।
৫. বানর জানত যে, কৃষককে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টায় তার নিজেরও মৃত্যু ঘটতে পারে, এতে বানর পিছপা হয়নি। অন্যের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েই বানর এ অভিযান পরিচালনা করেছিল।
৬. কৃষককে নিয়ে বানর কূপ থেকে ওঠার পর ভীষণ পরিশ্রান্ত হলো। কৃষকও ছিল প্রায় অচেতন। এ সময় অচেতন কৃষকের কোলে মাথা রেখে বানর একটু বিশ্রাম নিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কৃষকের সম্বিৎ ফিরে এলো। বানরকে কাছে পেয়ে তার অন্তরে লোভ ও মোহচৈতন্য জাগ্রত হলো। তখন তার চিত্তে অকৃতজ্ঞতাবোধ তীব্র হলো। বিশ্রামে ঘুমন্ত বানরটিকে হত্যা করে মাংস নিয়ে ঘরে যাবার বাসনা হলো কৃষকের। সেরকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক খণ্ড পাথর নিয়ে পরিশ্রান্ত অচেতন বানরের মাথায় আঘাত হানল কৃষক। এতে বানরের মৃত্যু ঘটল না বটে, কিন্তু মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বানর দ্রুত একটি গাছে উঠে পড়ল। বানর অত্যন্ত মনোকষ্ট পেল। কিন্তু কৃষকের প্রতি তার কোনো প্রকার প্রতিহিংসা বা ক্রোধ জন্ম নিল না।
৭. কারণ, কৃষককে বাঁচানোর জন্য সে নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এমনকি বানর তার কায়বাক্যে ও কর্মে কৃষককের প্রতি কোনো প্রকার শত্রুতা বা অসন্তুষ্টি দেখাল না।
৮. কৃষক যে বানরের জীবননাশের চেষ্টা করেছিল, তা বানর সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলল, এবং কৃষকের প্রতি আগের মতো মানসিক সমতা অব্যাহত রাখল।
৯. তারপর বানর অনুধাবন করল যে, কৃষক একাকী এ গহিন বনভূমি থেকে বের হওয়ার পথ না-ও চিনতে পারে। তাই বানর গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে চলে, তার মাথার ক্ষতস্থান থেকে যে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, সে রক্ত চিহ্ন দিয়ে কৃষককে পথনির্দেশ করতে লাগল। কৃষকও ভাবতে লাগলো রক্তাক্ত বানরের কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে, এতে তার উদ্দেশ্য সফল হবে। তাই সে রক্তচিহ্ন ধরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে কৃষক একসময় বন থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হলো। বানর কৃষককে বাঁচানোর সংকল্পটি এভাবেই শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে সক্ষম হলো।
১০. কৃষককের বাঁচানোর অভিপ্রায়ের মধ্যে বানরের কোনো প্রকার স্বার্থচিন্তা ছিল না। জাগতিক লাভ ও প্রশংসার মোহ, কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই বানর এ কাজ সম্পাদন করেছিল।
এ জাতকের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতাকে উল্লিখিত অনুক্রমিক ঘটনাগুলো পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে দশ পারমীর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
১. নিজের জীবন দিয়েও কৃষককে বাঁচানোর চেষ্টা বানরের যে নির্মোহ আত্মনিয়োগ, তা-ই 'দান পারমী'।
২. কৃষক পাথর দিয়ে মাথায় আঘাতের পরও বানব যে কৃষকের প্রতি কায়বাক্য ও কর্মে কোনো প্রকার বিদ্বেষ ও অসূয়ার ভাব দেখায়নি এটিই 'শীল পারমী'।
৩. কৃষকের জীবন রক্ষায় বানর কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করেনি এটি 'নৈষ্ক্রম্য পারমী'।
৪. বানর কৃষককে কূপ থেকে উদ্ধারের জন্য উপায় উদ্ভাবনের যে চেষ্টা করেছিল, তা হলো 'প্রজ্ঞা পারমী'।
৫. কৃষকের নিরাপদ উদ্ধারপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বানর কূপ প্রান্তে বারবার লাফ দিয়ে উঠে আসার পরীক্ষা চালিয়ে শেষে যে সাহসের সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তা 'বীর্য পারমী'।
৬. বানর মাথায় আঘাত পেয়ে দারুণ কষ্ট ভোগ করলেও কৃষকের প্রতি তার কোনো ক্রোধ, প্রতিহিংসা বা শত্রুতা ভাব জন্মেনি। এই অহিংস মনোভাব চেতনাই হলো 'ক্ষান্তি পারমী'।
৭. বানররূপী বোধিসত্ত্ব নিজের জীবন বিপন্ন করেও সেই কৃষকের জীবন রক্ষায় উচ্চারিত পূর্ব সংকল্প শেষ পর্যন্ত যে রক্ষা করেছিল সেই একনিষ্ঠ প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাই হলো 'সত্য পারমী'।
৮. কৃষক বানরকে হত্যার চেষ্টা করলেও বানর চিত্ত চঞ্চলতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সে সংযমের সঙ্গে একই ব্রতে শেষ পর্যন্ত অবিচলিত ছিল। এটিই হলো 'অধিষ্ঠান পারমী'।
৯. কূপে পতিত কৃষকের দুর্দশা দেখে বানরের হৃদয় যে করুণা ও প্রেমে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল, তা-ই হলো 'মৈত্রী পারমী'।
১০. বানর তার হত্যাপ্রচেষ্টার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে যে মানসিক ধৈর্য ও স্থিতি অব্যাহত রেখেছিল, তা-ই হলো 'উপেক্ষা পারমী'।
উপরিউক্ত বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পারমীর বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন রীতি থাকলেও এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক গভীর। যেমন মালায় গাঁথা ফুলের মতো। অসংযম ও চিত্ত বিভ্রান্তির কারণে যেকোনো একটি পারমী অনুশীলনে ব্যত্যয় ঘটলে অন্যগুলোর অনুশীলন বা পালন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পারমী শুধু একটি আচরণপ্রক্রিয়া নয়, এটি মানুষের মানসিকতা বিশুদ্ধকরণের এক মহা উপায়ও বটে। তাই জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জনে ও ক্লেশের বিনাশ সাধনে পারমী চর্চার প্রয়োজনীয়তা অনেক। নিজের চিত্তের উদারতা সৃষ্টিতে এবং সর্বজনীন আদর্শিক জীবন গঠনের পারমী একটি অনন্য পন্থা। বিশেষ করে অভেদ কল্যাণমুখী চেতনার জাগরণের জন্য পারমীর অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধধর্মের পরিভাষায় এটি পারমী নামে আখ্যায়িত হলেও এর আচরণগত উৎকর্ষের ফল সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়, মানবিক গুণাবলি আয়ত্ত করার জন্য প্রত্যেকের জীবনে এরকম বিধিবদ্ধ আচরণ থাকা আবশ্যক। কারণ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশানির্বিশেষে নিজ-নিজ মনের বিশুদ্ধতার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। সর্বজনীনভাবে এই ধারা অনুসরণ করলে আমাদের পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। ব্যক্তিজীবন হবে সুন্দর ও শান্তিময়। তাই বলা যায় যে, উন্নত মানবিক ও গুণসম্পন্ন চরিত্র গঠনে পারমী চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জীবনে পারমী একটি অনন্য পালনীয় জীবনবিধি।
বৌদ্ধধর্ম কালের প্রবাহে দুটি ধারায় বিস্তৃত হয়েছে। এর একটি থেরবাদ বা হীনযান; অন্যটি মহাযান নামে পরিচিত। থেরবাদ বলতে আদি বৌদ্ধধর্মের নিয়ম-নীতি অনুসরণকারীদের বোঝানো হয়। অর্থাৎ তথাগত বুদ্ধের সময় বিধিবদ্ধ রীতি ও সংস্কার পালনকারীদের বলা হয় থেরবাদী বা হীনযানী। অন্যদিকে যুগের প্রয়োজনে বৌদ্ধ আদি সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে যারা অনুসরণ করেন, তাদের বলা হয় মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। উভয় চর্চায় বৌদ্ধ দর্শন ও মৌলিক তত্ত্বে কোনো পার্থক্য নেই। যেমন: থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের পারমী বিধি মহাযান বৌদ্ধধর্মেও রয়েছে। তবে থেরবাদে এই পারমীর ধাপ দশটি হলেও মহাযানে এ ধাপ ছয়টি। এগুলো হলো যথাক্রমে-
১. দান পারমী
২. শীল পারমী
৩. ক্ষান্তি পারমী
৪. প্রজ্ঞা পারমী
৫. বীর্য পারমী
৬. ধ্যান পারমী
উল্লিখিত ছয় পারমীর মধ্যে থেরবাদের দশ পারমী বিদ্যমান। অর্থাৎ থেরবাদে অনুশীলনে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, মহাযানের ছয় পারমীর অনুশীলনে সেগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। তাই দৃশ্যত মহাযানে পারমী চর্চা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে মনে হলেও বাস্তবতায় উভয় বৌদ্ধধর্ম দর্শনে পারমীর সকল অনুসরণীয় বিধি বিদ্যমান এবং উভয়ই প্রায় সমরূপ।
পারমীর কোন কোন বিষয় নিজ জীবনে কীভাবে প্রয়োগ বা চর্চা করবে তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করো।
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
পারমীর কোন কোন বিষয় কীভাবে অন্যদেরও চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করবে, তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করো।
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না এর ঘরে (✔) চিহ্ন দাও।